মো. অসীম :: বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ হিসেবে বিবেচনা করা হয় বাংলাদেশকে, যা তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জলবায়ুর জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। সমগ্র বিশ্বজুড়ে চলছে জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন প্রভাব। বাংলাদেশও তার মধ্যে পিছিয়ে তো নেই বরং একটু বেশিই এগিয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আছে চরম ঝুঁকির মধ্যে। আবার যদি নারী ও পুরুষের কথা আলাদা আলাদা করে ভাবা হয় তা হলে সবাই এর প্রতিকূল অবস্থার শিকার। কিন্তু নারীরা একটু বেশি। শুধু দুর্যোগের সময় নয়, প্রায় সবসময়ই নারীরা একটু বেশি ভুক্তভোগী। বাংলাদেশের উপকূলীয় জনপদ, হাওরাঞ্চল, তিস্তা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার বন্যা ও নদীভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলোয় বসবাসকারীরা প্রতিনিয়ত জলবায়ু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
এই অঞ্চলের নারীরা নানা অর্থনৈতিক, সামাজিক, শারীরিক সমস্যার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় নারী দের অংশগ্রহণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে মাধ্যমিক পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া মেয়েদের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ঝরে পড়ছে, ফলে তারা কেউই কর্মোপযোগী কোনো দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। পারছে না কোনো সম্মানজনক অর্থ উপার্জনের পথ খুঁজে নিতে। একটি পরিবারে প্রতিদিন নারী ও পুরুষ উভয়ই যখন কাজ করে তখন কর্মক্ষেত্র থেকে প্রায় একই সময়ে ফিরে আসে। দুজনেই পরিশ্রান্ত। তবে ক্লান্ত নারীরা যখন রান্নাঘর থেকে শুরু করে পরিবারের সব কর্মকান্ডে মনোনিবেশ করে পুরুষ তখন বাড়িতে বসে টিভি কিংবা পত্রিকা পড়ে ।
অনেক সময় বন্ধুদের সঙ্গে সময় যাপন করে। বৈষম্য শুরু হয় এখান থেকে। এখানে যে বৈষম্য দেখছি তা সব ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবযুক্ত এলাকায় এ বৈষম্য একটু বেশিই হয়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উপকূল, পাহাড়ি ও দুর্গম অঞ্চলে এর প্রভাব বেশি হয় এবং এ অঞ্চলের নারীরা এর কুফল অনেক বেশি ভোগ করে থাকে। সবটুকু যাতনা তাদের ওপর দিয়ে যায়।
এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নারী ও শিশুর ওপর ব্যাপক সামাজিক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দিন দিন মানুষের কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। ফলে পরিবারের পুরুষরা নতুন জীবিকার খোঁজে স্থায়ীভাবে অথবা বছরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন, যার ফলে মৌসুমি অভিবাসন বাড়ছে। ফুড ফর হাংগ্রির অর্থায়নে সেন্টার ফর পিপল অ্যান্ড এনভায়রনের (সিপিই) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, কক্সবাজার জেলায় প্রায় ১০ শতাংশ, পটুয়াখালী জেলায় প্রায় ৩০ শতাংশ, বরগুনা জেলায় প্রায় ৩৪ শতাংশ মৌসুমি অভিবাসন হয় জীবিকার তাগিদে।
এই অভিবাসনের কারণে নারীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। অভিবাসিত পুরুষের একটি বড় অংশ বহুবিবাহে জড়িত পড়ার কারণে ডিভোর্সের হার বাড়ছে, বাড়ছে নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা। গবেষণায় আরও দেখা যায়, বেশিরভাগ মৌসুমি অভিবাসিত লোকজন ইটভাটায় কাজ করে। যেসব পরিবার নারী, শিশুসহ অভিবাসিত হয়, সেসব নারী ও শিশুরা ইটভাটায় কাজ করে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, পাশাপাশি স্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে বড় রকমের প্রভাব।
উপকূলীয় জেলাগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর লবণাক্ততা বাড়ছে এবং এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর। উপকূলীয় অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে, পরিষ্কার পানির অভাবে নারীরা দূষিত লবণাক্ত পানিতে ঋতুস্রাবের কাপড় পরিষ্কার এবং গোসল করতে বাধ্য হচ্ছেন; যার প্রভাব সরাসরি প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে। সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, কালীগঞ্জ ও শ্যামনগর উপজেলায় যথাক্রমে ৩৯.৯, ৪১.০ ও ৪০.০ শতাংশ নারী ও কিশোরী প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে বলে জানা যায়। কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্যের এই জটিলতার কারণেও এসব এলাকায় কিশোরীদের বাল্যবিয়ে বাড়ছে এবং অল্প বয়সে সন্তান প্রসবের কারণে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন নারীরা।
জলবায়ু পরিবর্তন ও ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ছেলেদের তুলনায় মেয়ে শিক্ষার্থীরা বেশি ঝরে পড়ে ও বেশি অপুষ্টির শিকার হয়। কারণ যেটুকু খাবার জোগার হয় তা ছেলে শিশুর জন্য তোলা থাকে। মেয়েকে সর্বংসহা বিবেচনা করে বঞ্চিত করা হয়। নানা কারণে মেয়েশিশুরা গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়ে। এ সময় তারা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে পড়ে।
জলবায়ু পরিবর্তন মূলত পাঁচভাবে মেয়েশিশুর জীবনকে প্রভাবিত করে। প্রথমত মেয়েশিশুর স্কুল থেকে ঝরে পড়ে কিংবা ঝরে পড়তে বাধ্য হয়, দ্বিতীয়ত বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে আরেকটি শিশুর জন্মদান করে, তৃতীয়ত তারা নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়, চতুর্থত তাদের অর্থ উপার্জনের সব পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং পঞ্চমত তারা বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে।
কোনো কোনো পরিবারে এ সময় বাল্যবিয়ের মতো ন্যক্কারজনক কাজটিও সাধিত হয়। যে শিশুটি নিজেকেই ভালো করে বুঝে উঠতে পারেনি, তাকে সাজিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যার এখন পুতুল খেলার সময় সে হয়ে যায় অন্য বাড়ির বধূ। তার ওপর অর্পিত হয় একটি সংসারের দায়িত্ব তথা অনেক কাজ। হয়তো সেখানেও তাকে দূর-দূরান্ত থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করে অন্যদের পিপাসা মেটাতে হয়। সময়ের সঙ্গে ছোট্ট দেহের মধ্যে ধারণ করতে হয় তারই মতো আরেকটি পুতুল। শুরু হয় নতুন করে আরেক দুর্বিষহ জীবন।
একটু সচেতন হলে সহজেই এ সমস্যার মোকাবিলা বা সমাধান করা সম্ভব। আজ বাংলাদেশের যে উন্নয়ন হয়েছে সেখানে রয়েছে মেয়ের ব্যাপক অংশগ্রহণ, বিষয়টি মনে রাখতে হবে। আবার একথাও ঠিক যে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন হয়েছে তাও অনেকটা শহরকেন্দ্রিক। মেয়েশিশুদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া রোধ করতে হবে। তাদের মধ্যেই জাগিয়ে তুলতে হবে সচেতনতা।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেসব এলাকায় বেশি সেসব এলাকায় মেয়ে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার জন্য অনেক বিনিয়োগ করার সদিচ্ছা থাকতে হবে। সব এলাকার সব শিশুর মেধা সমান নয়। সে বিবেচনা মাথায় রেখে বিদ্যালয়ের কারিকুলাম প্রস্তুত করতে হবে। রোধ করতে হবে বাল্যবিবাহ। এ জন্য সবার দরকার সামাজিক সুরক্ষা। এই সামাজিক সুরক্ষাটি আসবে গণসচেতনতা থেকে, এ জন্য আমাদেরকে বেশী বেশী রেডিও, টেলিভিশনে প্রচার করতে হবে। স্কুল-কলেজ ও বিভিন্ন এলাকায়, মহল্লায় সেমিনার করতে হবে প্রয়োজনবোধে উঠান বৈঠকও করা যেতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :