যৌক্তিক সময় বনাম দ্রুত নির্বাচন


নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশের সময় : অক্টোবর ২, ২০২৪, ১১:২৬ পূর্বাহ্ন /
যৌক্তিক সময় বনাম দ্রুত নির্বাচন
আগামী নির্বাচনে বিএনপিই যে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। বিএনপির অনুপস্থিতিতে যেমন আওয়ামী লীগ একক শক্তিশালী রাজনৈতিক দল, তেমনি আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বা দুর্বল উপস্থিতিতে বিএনপিও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অনেকেই মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিএনপির রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার। তবে সে সময়টা নির্ভর করছে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক ঘোষিত ও গৃহীত রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচি সম্পন্ন করার ওপর। তারা সেসব কাজ এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছে। সে কাজগুলো সম্পন্ন করা যে রূপকথার আলাদিনের চেরাগের দৈত্যের ন্যায় ‘বাঁ হাতের খেল’ নয়, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর তা করতে হলে দরকার দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বাত্মক সহযোগিতা। তারা সে সহযোগিতা করতে পারে সরকারকে সংস্কার কর্মসূচি সম্পন্ন করার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিয়ে।

কিন্তু বিএনপির সাম্প্রতিক কথাবার্তায় সে সময় দেওয়ার বিষয়টি উপেক্ষিত বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তারা বলছে যে, সাংবিধানিক সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়, এটা পরবর্তী পার্লামেন্ট করবে। এ সরকার দ্রুত একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দায়িত্ব থেকে সরে যাক, এটাই তারা চায়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক অনুষ্ঠানে যেসব কথা বলেছেন, তার সারমর্ম এটাই। এখানে স্মর্তব্য যে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই ৭ আগস্ট দলটি সমাবেশ করে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানালেও পরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিএনপি মহাসচিব সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের জন্য বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দেবে। কিন্তু ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে জেএসডির অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব যে বক্তব্য রেখেছেন, তাতে নির্বাচন প্রশ্নে দলটির ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, সংবিধান সংশোধন কিংবা পুনর্লিখনের যে দাবি উঠেছে, তা করার এখতিয়ার শুধু নির্বাচিত সংসদের। এজন্য নির্বাচন কমিশন সংস্কার করে অতি দ্রুত নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর সেই সরকার সিদ্ধান্ত নেবে কোথায় কোন জায়গায় পরিবর্তন করতে হবে। তখন সংবিধান নতুন করে লিখতে হবে, নাকি সংশোধন হবে সেটা সংসদ সিদ্ধান্ত নেবে।’ রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সরকারকে ‘পর্যাপ্ত’ সময় দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার এক মাস পার না হতেই বিএনপির এই ইউটার্ন সচেতন ব্যক্তিদের মধ্যে কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তাহলে কি কোনো কারণে বিএনপির সংশয় সৃষ্টি হয়েছে, নির্বাচনে দেরি হলে তাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার পথে নতুন কোনো প্রতিবন্ধক সৃষ্টি হতে পারে? মির্জা আলমগীর সাহেব সেটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে টিআইবি আয়োজিত ‘নতুন বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন: তরুণদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, যিনি দুদক সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশনেরও প্রধান, তিনি বলেছেন, ‘নতুন বাংলাদেশের অভীষ্ট অর্জন করতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ অপরিহার্য।’ অনুমেয় যে, তার এ মন্তব্যই বিএনপি মহাসচিবের উদ্বেগের কারণ। তিনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে অন্তর্বর্তী সরকার-সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের ইন্ধনের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘সমাজের গুরুত্বপূর্ণ লোক বিভ্রান্তমূলক কথা বলছেন। এ সরকার যাদের দায়িত্ব দিয়েছে তাদের মধ্যে অনেকে বলছেন নতুন দল করতে হবে। আমাদের বিস্ময় লাগে নতুন দল গঠনের দায়িত্ব তাদের কে দিয়েছে? তাহলে বলেন, জনগণ কীভাবে বুঝবে তারা নিরপেক্ষ কাজ করছে?’

অন্যদিকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর নয়াপল্টনে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার ভার্চুয়াল বক্তব্যে বলেছেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রয়োজনে নতুন দল আসা দোষের কিছু নয়। কারণ জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে তারা কোন দলকে সমর্থন করবে। তারেক রহমানের বক্তব্যর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই। কেননা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধান মেনে দল গঠন বা দলে যোগদান একজন নাগরিকের অধিকার। সে হিসেবে যদি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সমাজের আগ্রহী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন, তাহলে সেটাকে স্বাগত জানানোই গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির জন্য শোভনীয়। এ ক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বক্তব্যের সঙ্গে মহাসচিবের বক্তব্যের বৈপরীত্য লক্ষণীয়। তারেক রহমান তার বক্তব্যের দ্বারা প্রকারান্তরে নতুন দলকে (যদি গঠিত হয়) আগাম স্বাগত জানিয়েছেন। আর মহাসচিব ব্যক্ত করেছেন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাত্রজীবনে চীনপন্থি বাম ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই গণচীনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মাও সেতুংয়ের ‘লেট দ্য ব্লুজম হান্ড্রেড ফ্লাওয়ার্স’ বা ‘শতফুল ফুটতে দাও’ বাণীটির সঙ্গে পরিচিত। সুতরাং একটি নতুন দলের সৃষ্টির সম্ভাবনায় তো তার আপত্তি থাকার কথা নয়। বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে অনাগত সে দলটি বিএনপির সহযাত্রী হতে পারে।

বিএনপি মহাসচিবের কথায় এটা স্পষ্ট যে, তারা মনে করছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সময়ক্ষেপণের চেষ্টা করছে এবং দেশে তৃতীয় একটি রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুদয়ে ইন্ধন জোগাচ্ছে। তাদের এরকম মনে হওয়ার কারণও আছে। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশ কর্তৃক ‘বাংলাদেশ নাগরিক শক্তি’ নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। অনেকে মনে করছেন, এ সংগঠনটি নতুন রাজনৈতিক শক্তির আত্মপ্রকাশে নিউক্লিয়াসের ভূমিকা পালন করতে পারে। বিএনপি সম্ভবত এ আশঙ্কা করছে, ইউনূস সরকার নির্বাচনে সেই নতুন দলকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে, যা একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে।

বিএনপির এ আশঙ্কা একেবারে অমূলক তা বলা যাবে না। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার দেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা জাতিকে এ ওয়াদাও করেছে, দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন-ব্যবস্থার সংস্কার করতে যে সময়ের প্রয়োজন, তার বেশি সময় তারা নেবে না। অন্যদিকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, দেড় বছরের মধ্যে গণতন্ত্রে উত্তরণের কাজ সম্পন্ন হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর নির্বাচন বা গণতন্ত্রে উত্তরণ সম্পর্কে এটাই প্রথম সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলোর এ নিয়ে উদ্বিগ্ন বা ব্যতিব্যস্ত হওয়ার সংগত কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না।

এটা তো সবারই জানা যে, গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ দেশের নির্বাচন-ব্যবস্থা লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। তারা মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, নির্বাচনকে পরিণত করেছিল হাস্যরসের বিষয়ে। যে জঞ্জাল সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো অপসারণ করে সাবলীল পথ রচনা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বিষয়টি যদি এমন হতো যে, সামনের একটি মাত্র নির্বাচন অনুষ্ঠানই এ সরকারের একমাত্র কাজ, তাহলে তারা দ্রুত সেটা সম্পন্ন করার পথে এগোতে পারত। কিন্তু আওয়ামী লীগ পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে এমনভাবে বিকল করে দিয়েছে, এর এক-দুটি যন্ত্রাংশ বদল করে তা সচল করা সম্ভব হবে না। এজন্য প্রয়োজন পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের ওভারহোলিং; যেমন করা হয়ে থাকে বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্পকারখানা পুনরায় চালু করার ক্ষেত্রে। এই ওভারহোলিং করতে হলে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা শেষে ত্রুটিসমূহ চিহ্নিত করে অকেজো মেশিনারিজ পরিবর্তন করে নতুন মেশিনারিজ সংযোজন করতে হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রকে সচল করে গণমুখী করতে হলে সেরকম ওভারহোলিং দরকার বলে মনে করছেন রাজনৈতিক অভিজ্ঞমহল।

বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, রাষ্ট্রের সংস্কার নির্বাচিত পার্লামেন্ট করবে। অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত কথা সন্দেহ নেই। কিন্তু এ বিষয়ে রয়েছে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা। সে অভিজ্ঞতা বলে, রাজনৈতিক দলের সরকার দ্বারা কখনো জনকাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র সংস্কার হয় না। কেননা, তাদের প্রতিটি পদক্ষপ বা কর্মসূচিতে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব প্রবলভাবে কাজ করে। মনে থাকার কথা, ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাতদলীয় জোট, আওয়ামী লীগের আট দল ও পাঁচদলীয় বামমোর্চা—এ তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। কথা ছিল ১৯৯১-এর নির্বাচনে যে দলই সরকার গঠন করুক, তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সন্নিবেশিত করতে হবে। সে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল বিএনপি। ক্ষমতায় গিয়ে তারা তিন জোটের সে রূপরেখার কথা বিস্মৃত হয়েছিল। প্রবৃত্ত হয়েছিল রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের। যে কারণে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশে অনুষ্ঠিত হয় একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন। আবার সে বছরই আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির সম্মিলিত আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংযোজনে বাধ্য হয়। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১২ জুনের নির্বাচনে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। দুর্ভাগ্যজনক হলো, সেই আওয়ামী লীগই ২০০৮ সালের নির্বাচনে পুনরায় সরকারে গিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ২০১১ সালে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দেয়। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারা কখনোই জনকাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র সংস্কার সম্ভব নয়।

আর এজন্যই সচেতন ব্যক্তিরা মনে করেন, নির্বাচন-ব্যবস্থাসহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র সংস্কারের কাজটি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেই করে যেতে হবে। অন্যথায় সবকিছু আবার এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। কেননা আমাদের দেশের রাজনীতিতে লঙ্কায় গিয়ে রাবণে পরিণত হওয়ার নজিরের অভাব নেই।

লেখক: মহিউদ্দিন খান মোহন, সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।