মাওলানা মিজানুর রহমান : হজরত রাসুল (সা.) বললেন, ‘তিনটি স্থানে কেউ কারও কথা স্মরণ রাখবে না। ১. মিজানের নিকট। ২. আমলনামা প্রদানের সময়, যখন প্রত্যেককে বলা হবে, ‘তোমাদের নিজ নিজ আমলনামা পাঠ করো।’ ৩. পুলসিরাতের নিকট, ‘যখন তা জাহান্নামের উভয়পাড় ঘেঁষে ওপরে বসানো হবে’
পৃথিবী হচ্ছে মানুষের জীবনের পরীক্ষার ক্ষেত্র। পরীক্ষার খাতায় যেমন যা ইচ্ছা লেখা যায়; তেমনি পৃথিবীতেও মানুষ যা ইচ্ছা করতে পারে। কেউ ইচ্ছা করলে সৃষ্টিকর্তার হুকুম পালন করবে, ইচ্ছা করলে করবে না। তবে সব পরীক্ষারই একটা ফল থাকে। এই পরীক্ষারও ফল থাকবে। মূলত আল্লাহ মানুষকে তার ইবাদতের জন্য পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে তিনি বলেন, ‘আমি মানব ও জিন জাতিকে আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা জারিয়াত: ৫৬)। পৃথিবীতে যারা আল্লাহর আনুগত্য মেনে ইবাদত করবেন, তারা কৃতকার্য ও বিজয়ী হবেন। আর যারা ইবাদত করবে না, তারা হবে অকৃতকার্য। কর্মচারী কাজ করলে মালিক তাকে পুরস্কার দেন, কাজ না করলে দেন শাস্তি। আল্লাহও তার বান্দাদের পুরস্কার এবং শাস্তি দেবেন। প্রত্যেককে নিজেদের কৃতকর্মের পুরস্কার ও শাস্তি দেওয়া হবে। সেই বিচারিক আদালতই হলো ‘হাশরের মাঠ’। যার একমাত্র এবং চূড়ান্ত বিচারপতি ও অধিপতি হবেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন।
বিচারের মাঠ কখন হবে?
আল্লাহর ফেরেশতা হজরত ইসরাফিল (আ.) নির্ধারিত সময়ে শিঙায় ফুঁ দেওয়ার পর পৃথিবীর সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। পাহাড়-পর্বত, নদীনালা, বন-জঙ্গল কোনো কিছুরই অস্তিত্ব থাকবে না। সেদিনের কথা চিন্তা করে নবীজি (সা.) বলতেন, ‘কীভাবে আমি আনন্দ উল্লাস করব, অথচ ইসরাফিল (আ.) মুখে শিঙা লাগিয়ে শির অবনত করে গভীর মনোযোগে কান পেতে অপেক্ষা করছেন—কখন শিঙায় ফুঁ দেওয়ার হুকুম আসে।’ হজরত মুকাতিল (রহ.) বলেন, শিঙাটা শিংয়ের মতো। শিঙার গোলাকার মুখটি সাত আসমান ও জমিনের সমান। তিনি অপলক নেত্রে আরশের দিকে তাকিয়ে প্রতীক্ষা করছেন—কখন আদেশ করা হয়। প্রথববার যখন শিঙায় ফুঁ দেবেন, তখন আকাশ ও পৃথিবীর সব বাসিন্দা বেহুঁশ হয়ে মারা যাবে শুধু কয়েকজন ছাড়া। তারা হলেন—জিবরাইল, মিকাইল, ইসরাফিল ও মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাইল (আ.)। অতঃপর আল্লাহ মৃত্যুর ফেরেশতাকে তাদের প্রাণ কবজ করার হুকুম দেবেন। তারপর আল্লাহর হুকুমে মৃত্যুর ফেরেশতার মৃত্যু হবে। অতঃপর ৪০ বছর পর্যন্ত আল্লাহর কুদরতে সব রুহ আলমে বরজখে থাকবে। তারপর আল্লাহর হুকুমে ইসরাফিল (আ.) আবার জীবিত হবেন ও দ্বিতীয়বার ফুঁ দিলে সবাই জীবিত হয়ে হাশরের মাঠে একত্রিত হবে। পবিত্র কোরআনে এ কথাই আল্লাহতায়ালা বলেছেন—‘অতঃপর দ্বিতীয়বার শিঙায় ফুঁ দেওয়া হবে। তৎক্ষণাৎ তারা (জীবিত) হয়ে দাঁড়িয়ে (পুনরুত্থানের ভয়ংকর দৃশ্য) অবলোকন করতে থাকবে।’ (সুরা জুমার: ৬৮)
হাশরের মাঠের ভয়াবহতা
হাশরের মাঠের চিত্র হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। সেদিন পৃথিবী সৃষ্টি থেকে শুরু করে ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত সব মানুষকে জমায়েত করা হবে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘সেদিন পরিবর্তিত করা হবে এ পৃথিবীকে অন্য পৃথিবীতে এবং পরিবর্তিত করা হবে আসমানসমূহকে এবং লোকেরা পরাক্রমশালী এক আল্লাহর সামনে হাজির হবে।’ (সুরা ইবরাহিম: ৪৮)। হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন সাদা ময়দার রুটির মতো চকচকে একটি মাঠের ওপর সব মানুষকে একত্রিত করা হবে। সেখানে কারও কোনো নিশানা থাকবে না।’ (বোখারি সূত্রে মিশকাত: ৫২৯৮)। হাশরের মাঠে সময়টা হবে দীর্ঘ। সূর্য থাকবে মাথার অর্ধহাত ওপর (কারও মতে এক মাইল ওপর)। গরমে লোকদের বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। মানুষ অস্থির হয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করবে। সেদিন কারও পরনে কোনো বস্ত্র থাকবে না। কেউ কারও দিকে তাকাবেও না। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—‘মহানবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি, কেয়ামতের দিন মানুষকে উলঙ্গ পদে, উলঙ্গ দেহে ও খতনাহীন অবস্থায় কবর থেকে হাশরের ময়দানে জমায়েত করা হবে। এ কথা শুনে আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! নারী-পুরুষ সবাই কি উলঙ্গ হবে? তারা কি একে অন্যের প্রতি তাকাবে? (এরূপ হলে তো খুবই লজ্জার বিষয়)। উত্তরে তিনি বললেন, হে আয়েশা! কেয়ামতের দিনটি এত কঠিন ও বিপদময় হবে যে, মানুষের মনে একে অন্যের প্রতি তাকানোরও খেয়াল হবে না।’ (বোখারি-মুসলিম, মেশকাত: ৫৩০২)
হাশরের মাঠে মানুষ তার আপনজনদের ভুলে যাবে। সবাই নিজের চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত থাকবে। হজরত রাসুল (সা.) বললেন, ‘তিনটি স্থানে কেউ কারও কথা স্মরণ রাখবে না। ১. মিজানের নিকট। ২. আমলনামা প্রদানের সময়, যখন প্রত্যেককে বলা হবে, ‘তোমাদের নিজ নিজ আমলনামা পাঠ করো।’ ৩. পুলসিরাতের নিকট, যখন তা জাহান্নামের উভয়পাড় ঘেঁষে ওপরে বসানো হবে।’ (তিরমিজি: ২৪৩৩)
সুপারিশের জন্য আকুতি
ভয়াবহ এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে অস্থির হয়ে উঠবে লোকজন। তাদের দাবি হবে, বিচারের রায় যাই হোক না কেন, বিচারটা যেন দ্রুত হয়ে যায়। সেজন্য তারা নবীদের কাছে যাবে; যেন তারা আল্লাহর কাছে বিচার শুরু হওয়ার জন্য সুপারিশ করেন। হজরত আমাস (সা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন কেয়ামত হবে তখন মানুষ জনসমুদ্রের ভিড়ের মধ্যে হুমড়ি খেতে থাকবে। তারা তখন হজরত আদম (আ.)-এর কাছে আরজ করবে—আপনি আমাদের জন্য আল্লাহপাকের কাছে সুপারিশ করুন। তিনি বলবেন, আমি তার উপযুক্ত নই বরং তোমরা আল্লাহর খলিল হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কাছে যাও, কেননা তিনি আল্লাহপাকের অন্তরঙ্গ বন্ধু। তারা ইব্রাহিম (আ.)-এর কাছে হাজির হয়ে এরূপ আরজ করলে তিনিও বলবেন, আমি তার উপযুক্ত নই। তোমরা ইসা (আ.)-এর কাছে যাও। যিনি হলেন রুহুল্লাহ। অতঃপর তারা হজরত ইসা (আ.)-এর কাছে গিয়ে ওই কথা বলবে। তিনি বলবেন, আমি এ কাজের লায়েক নই। তোমরা বরং মুহাম্মদ (সা.)-এর খেদমতে যাও। তখন তারা আমার কাছে আসবে এবং আমি বলব, হ্যাঁ, আমি এজন্য আছি। অতঃপর আমি আল্লাহপাকের কাছে অনুমতি চাইলে আমাকে অনুমতি দেবেন এবং কতগুলো প্রশংসাবাণী আমার অন্তরে ঢেলে দেবেন, যেগুলোর দ্বারা আমি প্রশংসা করব কিন্তু সেগুলো এখন আমার কলবে অনুপস্থিত। অতঃপর আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির জন্য সিজদা করব। তখন বলা হবে, হে মুহাম্মদ আপনি মাথা ওঠান এবং যা খুশি বলুন, আজ আপনার কথা শোনা হবে। আমি তখন সব মানুষের হিসাব-নিকাশ শুরুর জন্য সুপারিশ করব।…’ (বোখারি: ৬৯৫৬; মুসলিম: ২৮৬)
আমলনামা প্রদান
বিচার শুরু হওয়ার পর আল্লাহতায়ালা সবার হাতে তাদের দুনিয়ার আমলনামা দেবেন। আমলনামা দেওয়ার সময় সবাই ভীতসন্ত্রস্ত থাকবে। কারণ আল্লাহ কারও আমলনামা ডান হাতে দেবেন, কারও দেবেন পেছন দিকে ঘুরিয়ে বাম হাতে। এ আমলনামায় তার দুনিয়ার প্রতিটি কর্মের কথা অক্ষরে অক্ষরে লেখা থাকবে। দুনিয়ায় প্রতিটি মানুষের সঙ্গে আল্লাহ দুজন ফেরেশতা রেখেছেন। একজন তার ডান কাঁধে থেকে তার নেক আমলগুলো লিখে রেখেছেন। অন্যজন বাম কাঁধে থেকে তার বদ আমলগুলো লিখে রেখেছেন। হাশরের দিন প্রত্যেকের হাতে সে আমলনামা দেওয়া হবে। এ বিষয়ে কোরআনে বলা হয়েছে—‘(আমলনামা দিয়ে আল্লাহ বলবেন) তুমি তোমার আমলনামা পড়ো। তুমি নিজেই আমলনামা পড়ে তোমার রায় লেখো—তোমার কী বিচার হওয়া উচিত।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ১৪)। সে আমলনামা দেখার পর অনেকের দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাবে যে, তার আমলনামায় নেক আমল বেশি, নাকি বদ আমল বেশি! তখন আল্লাহ তাদের সন্দেহ দূর করার জন্য মিজান তথা পাল্লার ব্যবস্থা করবেন। তাতে মেপে দেখাবেন কার আমলনামা কোন দিকে ভারী। মানুষ পৃথিবীতে যত যা কিছুই করে, সবই দেখতে পারবে পরকালে। প্রতিটি কৃতকর্মের বিচার হবে পরকালে। আমাদের পৃথিবীর জীবন সুন্দর হলে পরকালেও জীবনও হবে সুন্দর ও সুখময়।
লেখক: ইমাম ও খতিব
আপনার মতামত লিখুন :