মাওলানা যুবায়ের আহমাদ : পরিবার একটি পবিত্র সংস্থা। মানবশিশুর সর্বপ্রথম ও সর্বোত্তম শিক্ষালয়। পিতা-মাতাই সন্তানের প্রথম আদর্শ, শিক্ষক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এ যুগেও যেমন নবজাতকের জন্য মায়ের দুধের বিকল্প খাবার কিংবা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি; তেমনি সুনাগরিক তৈরিতে পরিবারের বিকল্প কোনো প্রতিষ্ঠান আজও গড়ে ওঠেনি। তাই ইসলাম পরিবারিক পরিবেশে দ্বীনচর্চার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে (জাহান্নামের) অগ্নি থেকে রক্ষা করো।’ (সুরা তাহরিম: ৬)
মানবশিশুর সবচেয়ে কার্যকর এ বিদ্যাপিঠে শিশুকে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। কিন্তু আধুনিকতার নামে সেই পারিবারিক শিক্ষায় যেমনি উপেক্ষিত মাতৃভাষা, তেমনি উপেক্ষিত স্বভাবধর্ম ইসলাম। অশ্লীল ও নগ্ন ফিল্মে তারা শিক্ষা নিচ্ছে চাপাতি-ছুরি দিয়ে অন্যকে হত্যা করার বিদ্যা। প্রতি বছর বাড়ছে জিপিএ ৫-সহ পাসের হার, তবে পাল্লা দিয়ে কমছে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা। অনেক বিত্তশালী পরিবারের অভিভাবক চাকরি-বাকরির ব্যস্ততায় সন্তানের খোঁজখবর নিতে পারছেন না। সন্তান কোথায় খাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে, কোথায় রাত কাটাচ্ছে; এতসব দেখার সময়ও তাদের হয়ে ওঠে না। অথচ সন্তানই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সম্পদ। সন্তান মাদকাসক্ত হলে মাদকের নেশায় সম্পদ নষ্ট করতে বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু সন্তান যদি আদর্শ মানুষ হয়, তাহলে সে বৈধভাবে সম্পদ উপার্জন করে চলতে পারবে। অভিভাবকদের উচিত সম্পদের পাহাড় গড়ার চেয়ে সন্তানের চরিত্র ও আদর্শ গড়ার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
আজকের শিশু আগামী জাতির কর্ণধার। তাকে আদর্শবান হয়ে গড়ে তোলার মহান দায়িত্ব পালনে পরিবাররের সদস্যদের আজই সতর্ক হতে হবে। দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে পিতা-মাতাকে। পরিবারেই দ্বীন শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। আকাশ, চন্দ্র-সূর্য, বৃষ্টিতে যে মহান শক্তির হাত, তা শুনিয়ে সুকৌশলে তিলে তিলে তার কোমল হৃদয়ে আল্লাহতায়ালার প্রতি অবিচল আস্থা-বিশ্বাস, ভালোবাসা ও ভীতির বীজ বপন করা একান্ত প্রয়োজন। তার সব কাজই মনিটরিং করা হচ্ছে, ভালো-মন্দ সব কাজের জন্যই তাকে জবাব দিতে হবে এমন এক আদালতে, যেই আদালত এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। পরকালের জবাবদিহির এ দৃঢ় বিশ্বাস তৈরি করে দিতে হবে শিশুর অন্তরে। পরকালের এ ভয়ই পারে অপরাধপ্রবণতা থেকে শিশুদের বাঁচাতে। সন্তান যতই ছোট হোক, এমনকি দুধের শিশু হলেও তার সামনে কোনো ধরনের যৌনালাপ ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এতে তার মস্তিষ্কে নির্লজ্জতার যে ছাপ পড়বে, তাতে শয়তানের কুমন্ত্রণায় তা প্রকট হয়ে উঠবে। অনেক সময় শাসন করতে গিয়েও বেশি কঠোরতা দেখানোয় ফল হয় বিপরীত। সামান্য অন্যায়ে বকাঝকা করা অনুচিত। প্রয়োজনে একান্তে বসে শাসন করা উচিত।
ইসলামী অনুশাসনের প্রতি তাকে আগ্রহী করার শ্রেষ্ঠ সময় এখনই। অশ্লীলতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পরিবারে পর্দার বিধান কঠোরভাবে মেনে সন্তানকে এর প্রতি আকৃষ্ট করে তুলতে হবে। বাবা-মাকেই প্রথমে সময়মতো নামাজ আদায়ের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। সন্তানকেও শেখাতে হবে নামাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) সন্তানকে শৈশবেই নামাজের আদেশ করতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের সন্তানের বয়স যখন সাত বছর হয়, তখনই তাদের নামাজের আদেশ দাও!’ (আবু দাউদ: ৪৯৫)। আপনিই কিন্তু আপনার সন্তানের প্রথম আদর্শ। সন্তানের ভালো কাজের একটা অংশ যেমন পিতা-মাতা পেয়ে থাকেন, তেমনি সন্তানের পদস্খলনের দায়ভার আপনাকেই নিতে হবে। আবার সন্তানকে মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে সে যত ভালো কাজ করবে, তার সওয়াবও আপনি পেতে থাকবেন। হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘জান্নাতে কোনো কোনো ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি করা হলে তারা বলবে কীভাবে আমার মর্যাদা বৃদ্ধি পেল? তখন তাকে বলা হবে, তোমার জন্য তোমার সন্তানের ক্ষমাপ্রার্থনার ফলে।’ (মুসনাদে আহমাদ: ৮৫৪০; মেশকাত: ২৩৫৪)।
মানবশিশু ছোট সময় যা শেখে সারা জীবন তা তার হৃদয়ে বদ্ধমূল থাকে। তাই উদাসীনতা নয়; পিতা-মাতার জন্য দোয়া করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে ছোট সময়ই। আপনার-আমার সবার পরিবারে দ্বীনচর্চা হোক, শিশুকে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হোক। আগামীর পৃথিবী হোক সুন্দর। নৈতিক বলে বলীয়ান হোক আমাদের আগামী প্রজন্ম।
আপনার মতামত লিখুন :