নানামুখী জীবনসংগ্রামে দেশের মানুষের যখন নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম, তখন দেশের উত্তরাঞ্চলে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। দেশের রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধাসহ তিস্তাপাড়ের লাখো মানুষ পানিবন্দি। টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে রংপুর জেলার কাউনিয়া রেলসেতু পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি নিয়ন্ত্রণে খুলে দেওয়া হয় ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট। বিশেষ করে নদী-তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল এবং চরাঞ্চলগুলোতে নদনদীর পানি ঢুকে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। ক্ষতি হয়েছে ফসলের। দেখা দিয়েছে ভাঙন আতঙ্ক। তিস্তা নদীর অববাহিকায় বিশাল এলাকাজুড়ে রোপণ করা আমন ধান, মরিচ, বেগুন, বাদাম, পটোলসহ বিভিন্ন সবজির ক্ষেত পানিতে ডুবে যায়। এ ধরনের বন্যা-প্লাবন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুহূর্তে অসহায় মানবতার পাশে দাঁড়ানো দল-মত নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার ধর্মপ্রাণ মানুষের অবশ্য কর্তব্য।
দেশের একটি অংশে যখন বন্যা পরিস্থিতি অবনতির কারণে অসহায় মানুষ যখন পানিবন্দি অবস্থায় জীবনযাপন করে, তখন সমাজের বিত্তবানদের বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও সাহায্য-সহযোগিতা করা ইসলামের বিধান। টাকা-পয়সা, খাদ্য, বস্ত্র, পানি, ওষুধ—যার যা কিছু আছে, তা নিয়েই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। বন্যা উপদ্রুত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত বানভাসি মানুষ অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ও চিকিৎসার অভাবে অর্ধাহার-অনাহারে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে দিনযাপন করছে। দুঃখের রজনী যেমন শেষ হতে চায় না, তেমনি বানভাসি মানুষের কাছে এখন একেকটি দিন যেন দুর্বিষহ কষ্টের অনন্তকাল। হাদিস শরিফে দুনিয়ায় ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত মানুষকে অন্ন ও বস্ত্রদানের পরকালীন প্রতিদান ঘোষণা করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়ায় মানুষকে খাদ্যদান করেছে, সেদিন তাকে খাদ্যদান করা হবে। যে আল্লাহকে খুশি করার জন্য মানুষকে পানি পান করিয়েছে, তাকে সেদিন পানি পান করিয়ে তার পিপাসা দূর করা হবে। যে মানুষকে বস্ত্রদান করেছে, তাকে সেদিন বস্ত্র পরিধান করিয়ে তার লজ্জা নিবারণ করা হবে।’ (আবু দাউদ)।
বন্যায় অনেক দরিদ্র পরিবারের বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ ও জীবন-জীবিকার ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বহু রাস্তাঘাট, দোকানপাট, বসতভিটা, জমি-জিরাত, ফল-ফসল নিশ্চিহ্ন ও বিলীন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বন্যাকবলিত অঞ্চলের অসহায় বানভাসি মানুষ কতটা দুঃখ-কষ্টের মধ্যে পড়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। বন্যাদুর্গত বিভিন্ন এলাকায় পানিবাহিত নানা ধরনের রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের অভাবে তারা সুচিকিৎসা পাচ্ছে না। দেশের প্রধান নদনদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় প্রবল স্রোতে পানির সংযোগ পাইপ, গভীর নলকূপ ও কুয়া চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সর্বত্র বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে বন্যা উপদ্রুত এলাকায় মানবেতর জীবনযাপনরত বানভাসি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ তৎপরতা, শুকনো খাদ্যসামগ্রী প্রদান, আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক। যেমনভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) দিকনির্দেশনা প্রদান করে বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ বা রুগণ ব্যক্তির সেবা করো এবং বন্দিকে মুক্ত করো অথবা ঋণের দায়ে আবদ্ধ ব্যক্তিকে ঋণমুক্ত করো।’ (বোখারি)।
দেশের এ দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে নিজের চেয়ে বেশি ভাবা দরকার দুর্গতদের নিয়ে। ইসলামে প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে পূর্ণ আহারকারীর ইমানকে বলা হয়েছে ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ওই ব্যক্তি পরিপূর্ণ মুমিন নয়, যে তৃপ্তিসহকারে আহার করে অথচ তার প্রতিবেশী থাকে ক্ষুধার্ত।’ (শুয়াবুল ইমান: ৫৬৬০)। রাসুল (সা.) একদিন আবু জর (রা.)-কে বললেন, ‘হে আবু জর! তুমি যখন তরকারি পাকাও, তখন তাতে একটু বেশি পানি দিয়ে ঝোলটা বাড়িয়ে নিও এবং তোমার প্রতিবেশীকে তা পৌঁছে দিও।’ (মুসলিম: ৬৮৫৫)। হাদিসে অসহায় মানুষকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করার ক্ষমতা না থাকলে তরকারির কিছু ঝোল দিয়ে হলেও মানুষের পাশে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। এজন্য নিজেদের খরচের বাজেট কমিয়ে হলেও অসহায় মানুষগুলোর কষ্ট ভাগাভাগি করে নেওয়া উচিত। পৃথিবীর কোথাও কোনো মানুষ বিপদগ্রস্ত হলে মানুষ হিসেবে তার বিপদে এগিয়ে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব। রাসুল (সা.) সব মুসলমানকে একটা দেহের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া-মায়া ও স্নেহ-মমতার দিক থেকে গোটা মুসলিম সমাজ একটি দেহের সমতুল্য। যদি দেহের কোনো বিশেষ অঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গেও তা অনুভূত হয়; সেটা জাগ্রত অবস্থায়ই হোক কিংবা জ্বরাক্রান্ত অবস্থায়।’ (মুসলিম : ৬৭৫১)।
যে ব্যক্তি শুধু প্রথাগত ইবাদত করে, কিন্তু আল্লাহর রাস্তায় বিপদগ্রস্ত ও দুস্থ মানবতার কল্যাণের জন্য দান-খয়রাত, জাকাত-সদকা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসে না; সমাজের অসহায় বিপন্ন, বন্যাদুর্গত ও ক্ষতিগ্রস্ত নিঃস্ব অর্ধাহারি-অনাহারি গরিব মানুষের অভাব দূরীকরণ, চরম ক্ষুধা নিবারণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে দানের হাত সম্প্রসারিত করে না অর্থাৎ দানশীলতা ও বদান্যতার চর্চা করে না; ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে অংশ নেয় না; সে আল্লাহ ও তার রাসুলের কাছে কখনোই প্রিয়ভাজন হতে পারবে না। বৈধ সম্পদ থেকে দরিদ্র ব্যক্তিকে দানের সওয়াব সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘কেউ হালাল উপার্জন থেকে দান করলে আল্লাহ নিজে সেই দান গ্রহণ করেন, সেটি উত্তমরূপে সংরক্ষণ করেন। একসময় সেই দানের সওয়াব পাহাড়তুল্য হয়ে যায়।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
বন্যা-দুর্যোগ আল্লাহরই হুকুমে আসে। কাজেই আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা এবং তার কাছে মুক্তির উপায় অন্বেষণ করা মুমিনের কর্তব্য। আল্লাহর হুকুম দুই প্রকারের—প্রাকৃতিক হুকুম এবং করণীয়-বর্জনীয়ের হুকুম। জীবন ও জগতে আল্লাহর ইচ্ছাই কার্যকর, তার ইচ্ছাকে রদ করার কেউ নেই। জীবনের বিস্তৃত অঙ্গনে এই সত্য পুনঃপুনঃ প্রকাশিত। কাজেই তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা কর্তব্য। বিপদাপদ আল্লাহরই তরফ থেকে, এ উপলব্ধি মানুষের মনে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করে। আর আল্লাহর ভয়ই পারে মানুষের কর্ম ও আচরণকে সংশোধন করতে। যে বান্দা ক্ষণস্থায়ী জীবনের নানা দৃষ্টান্ত থেকে আল্লাহর পরিচয় লাভ করে এবং তার আনুগত্যের পথ অবলম্বন করে সে চিরস্থায়ী জীবনে মুক্তি ও সফলতা অর্জন করে। পক্ষান্তরে যে গাফিলতি ও উদাসীন থাকে এবং অবাধ্যতা ও নাফরমানির মধ্যে সময় কাটায় সে চিরস্থায়ী জীবনে ব্যর্থ ও বন্দি হয়। কাজেই মানুষের কর্তব্য, জীবন ও জগতে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো থেকে শিক্ষা ও উপলব্ধি অর্জন করে নিজ করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং আল্লাহর ফরমাবরদারীর দিকে প্রত্যাবর্তন করা।
আল্লাহর হুকুমে মানুষ যখন বিপদাপদে আক্রান্ত হয় তখন তার অসহায়ত্ব প্রকাশিত হয়ে পড়ে, ওই সময় আল্লাহ মহানের দিকে প্রত্যাবর্তন তার জন্য সহজ হয়ে যায়। কাজেই এ সময় আল্লাহমুখী হওয়াই স্বাভাবিকতা এবং এটিই মুমিনের গুণ। আর এ অবস্থাতেও আল্লাহর দিকে রুজু না করা দুর্ভাগ্যের লক্ষণ। আর ইসলাম মানবতার ধর্ম। এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত হলে তাদের পাশে দাঁড়ানো, বিপদ মুক্তির জন্য সাহায্য করা ইসলামের শিক্ষা। তাদের দুর্দিনে আর্থিক সহায়তা, খাবার-দাবার, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং চিকিৎসাসেবায় এগিয়ে আসা ইমানের দাবি। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের মতো অসহায়-দুর্গত মানুষদের সাহায্য করাও ইবাদত। আল্লাহতায়ালা মুমিনদের একটি দেহের মতো বানিয়েছেন। দেহের কোনো অংশ আক্রান্ত হওয়া মানে পুরো দেহ আক্রান্ত হওয়া। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনদের উদাহরণ তাদের পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া ও সহানুভূতির দিক থেকে একটি মানবদেহের মতো; যখন তার একটি অঙ্গ আক্রান্ত হয়, তখন তার পুরো দেহ ডেকে আনে তাপ ও অনিদ্রা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং: ৬৪৮০)।
আর যাদের সামর্থ্য রয়েছে তাদের প্রতি অসহায়-দুর্গত মানুষদের সাহায্য করতে পবিত্র কোরআনে নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা! আমি তোমাদের যে জীবনের উপকরণ দিয়েছি, তা থেকে তোমরা ব্যয় করো সেদিন আসার আগেই, যেদিন কোনো বেচাকেনা, বন্ধুত্ব ও সুপারিশ থাকবে না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত নং: ২৫৪)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দয়াশীলদের ওপর করুণাময় আল্লাহ দয়া করেন। তোমরা দুনিয়াবাসীকে দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের দয়া করবেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস নং: ৪৯৪১)। তবে এ ব্যয়, দান ও দয়া হতে হবে নিঃস্বার্থভাবে, অভাবী ও বিপন্ন মানুষের কাছ থেকে কোনোরকম প্রতিদানের আশা ছাড়া, কেবল আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির জন্য। যেমন আল্লাহতায়ালা সেদিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত এতিম ও বন্দিদের খাবারদান করে। শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের খাবারদান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’ (সুরা দাহর, আয়াত নং: ৮-৯)।
মনে রাখতে হবে, বন্যা সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে একটি প্রাকৃতিক পরীক্ষা। হজরত নুহ (আ.)-এর উম্মতদেরও আল্লাহতায়ালা বন্যার প্লাবনে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। নুহ (আ.)-এর কিশতির ঘটনা আজও ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। নাফরমানি, সুদ, জিনা-ব্যভিচার বেড়ে গেলে আল্লাহতায়ালা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে বান্দাদের শাস্তি দিয়ে থাকেন। সতর্ক করেন পাপ পঙ্কিলতার। বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও বন্যায় আক্রান্ত অসহায় মানুষদের সেবায় এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দিয়েছে ইসলাম। বিপদাপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো ইসলামের চিরকালীন শিক্ষা। আর্তমানবতার সেবায় মুসলিম শাসকরা রাতের আঁধারে ঘুরে ঘুরে অনাহারীদের মুখে খাবার জুটিয়েছেন। ইসলামের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন মুসলিম শাসকরা। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন, যে তার বান্দাদের প্রতি দয়া করে।’ (বোখারি ও মুসলিম)। তিনি আরও বলেছেন, ‘তোমরা পৃথিবীবাসীর প্রতি দয়া করো। আকাশের মালিক আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (মুসতাদরাক)। বন্যাদুর্গতের পাশে দাঁড়ানোর এক বড় উপায় হচ্ছে, বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। এ বিষয়েও সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেরও প্রয়োজন আছে। ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে এ উদ্যোগ নিতে পারেন। দেশে এমন অনেক বিত্তবান ব্যক্তি আছেন, যারা ইচ্ছে করলেই শত শত মানুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারেন। কাজেই সবাই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে এলে লাখ লাখ দুর্গত মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব হতে পারে। আল্লাহতায়ালা সবাইকে নেক কাজের তওফিক দান করুন।
লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ
আপনার মতামত লিখুন :